
প্রকাশিত: Wed, May 3, 2023 10:24 AM আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 12:38 PM
‘গার্ড অব অনার’, নারীবিদ্বেষ এবং পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা
ইমতিয়াজ মাহমুদ : [১] নিতান্ত নারীবিদ্বেষ থেকেই এসব মানুষ, হোক তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি বীর উত্তম বা অন্য কেউ। তারা নারীরা এটা করতে পারবে না বা সেটা করতে পারবে নাÑ এরকম সব অবস্থান নেন। নানা রকম সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন। কারণ তারা নারীকে পুরুষের সমান মানুষ মনে করেন না। তাদের যার যার ধর্মীয় বিশ্বাস এই অবস্থানে সহায়ক অনুষঙ্গ বটে, কিন্তু নারী ইউএনও গার্ড অব অনারে নেতৃত্ব দেবেনÑ এটাতে আপত্তি করে কাদের সিদ্দিকীর এই অবস্থান একটি রাজনৈতিক অবস্থান। ভুল করবেন না, এটা কেবল ধর্মীয় মতের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটা একটা রাজনৈতিক অবস্থান। পিতৃতন্ত্র ও নারীর মধ্যে শতাব্দীপ্রাচীন যে ক্ষমতার রাজনীতি, সেই লড়াইয়েরই এক একটা অংশ মাত্র এসব মতামত।
একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শেষ বিদায়ে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়, এটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় আচার মাত্র। এটা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। দেশের বীর সন্তান দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, রাষ্ট্র তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ বিদায়ে শেষ সালাম জানাবে, বিউগলে করুণ সুর বাজবে, এগুলো কোনোটাই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অংশ নয়। ধর্মীয় রিচ্যুয়ালটা হচ্ছে জানাজা। সেখানে একজন নারী অংশগ্রহণ করতে পারেন কী পারেন না সেটা নিয়ে যদি ধার্মিকরা তর্ক করে সেখানে আমি কিছু বলবো না। যদিও আমার জানামতে, জানাজায় নারীদের অংশগ্রহণ ইসলাম ধর্মমতে নিষিদ্ধ নয়, তবুও সেটা নিয়ে আমি তর্ক করবো না।
[২] তাইলে কাদের সিদ্দিকী বা অন্য যেসব লোক গার্ড অনারে নারী কর্মকর্তার উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি করেন, তারা কেন করেন? কেননা পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতামত তাদের শিরায় শিয়ার প্রবহমান। সমাজের ক্ষমতা পুরুষের হাতে আর সেইটাকে সংহত করার জন্য পিতৃতন্ত্র নারীর জন্য কিছু ভূমিকা নির্ধারণ করে রেখেছে আর সেইসব বিধানকে তারা স্বাভাবিক নিয়ম না প্রাকৃতিক নিয়ম বা আবহমান কালের প্রচলিত নিয়ম বলে চালিয়ে দেয়। নারীর জন্যে এই যে লিঙ্গভিত্তিক নির্ধারিত ভূমিকা এইগুলিকে পিতৃতন্ত্রে মহা পবিত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কাদের সিদ্দিকীও এর বাইরে নন, তিনিও ঠিক এই কারণেই নারীর নেতৃত্বে গার্ড অব অনার পছন্দ করছেন না।
নারীর জন্যে পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত ভূমিকাকে যে সমাজে মহা পবিত্র ও মহা সম্মানজনক মনে করা হয় সেটা আপনি প্রতি পদে পদেই দেখতে পাবেন। ধর্মীয় গুরুদের আপনি প্রতিদিনই বলতে শুনবেন সংসারে পুরুষের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখার পক্ষে নানাপ্রকার দোহাই দিয়ে যাচ্ছে। নারীকে স্বামীর কথা শুনতে হবে, স্বামীর আদেশ মানতে হবে, স্বামীর সেবা করতে হবে, স্বামীর বাধ্যগত হতে হবে, না হলে সেই নারী স্বর্গে যাবে না- এইরকম কথা আপনি অনেকবার শুনেছেন। এমনকি যারা নিজেদের অপেক্ষাকৃত লিবারেল মনে করেন তাদেরও দেখবেন নারীকে সম্মান করেন সেটা দেখানোর জন্য বলবেন, নারী মায়ের জাত, নারী বোনের জাত ইত্যাদি। এমনকি সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর যে রাজনৈতিক ধারা, মার্ক্সবাদী ও কমিউনিস্টরা, নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ইউরোপে ও আমেরিকায় দেখা গেছে যে কমিউনিস্টদের মধ্যেও দৈনন্দিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বা নেতৃত্বে নারীকে সমান সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে কমিউনিস্ট নারী কর্মীরা এবং মার্ক্সবাদীরা তারা পার্টির শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন।
[৩] বারবার সেই জন্য সেই কথাটাই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হয়, নারীর অধিকারের সংগ্রাম একটি রাজনৈতিক লড়াই তথা ক্ষমতার লড়াই। সমাজের কর্তৃত্ব থেকে পিতৃতন্ত্রকে হঠিয়ে নারী পুরুষের সমান অবস্থান নিশ্চিত করার সংগ্রাম তথা নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের সংগ্রাম। একটু বাড়তি মায়া দয়া করুণা বা কল্যাণের মধ্যে নারীর সংগ্রাম সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের অন্য সকল লড়াই- বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, সমাজতন্ত্রের জন্যে লড়াই এই সব সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও লড়তে হয়, কিন্তু সেই সাথে নারীকে লড়তে হয় একটা বাড়তি ফ্রন্টে, একটা বাড়তি লড়াই, সেটা হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই।
ওই বাড়তি লড়াইটা খুব সহজ নয়। এখানে আপনার প্রতিপক্ষ আপনাকে বলবে, আমি নারীকে খুব সম্মান করি, নারী হচ্ছে মায়ের জাত ইত্যাদি, এরকম মিষ্টি কথা বলেই আপনাকে রান্না ঘরের দরোজা দেখিয়ে বলবে যাও ওইখানে যাও, ওটাই মায়ের জাতের জায়গা। ওরা আপনাকে বলবে আমি নারীদের খুব ভালোবাসি, তারপর আপানর উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করবে, বলবে নারী মহা মূল্যবান ‘বস্তু’, হিরে জহরতের মতো। কখনো কখনো আপনার কল্যাণে দুইটা কথা বলবে, প্রশংসা করবে, মিষ্টি কথা বলবে, সবকিছু- কিন্তু নারী ও পুরুষ সমান এই কথাটা কখনো বলবে না। ভুল করবেন না।
ভুল করবেন না, পিতৃতন্ত্র আর নারীবিদ্বেষ এই দুইই বিরাজ করে একসাথে। কখনো কখনো পিতৃতন্ত্র আর নারীবিদ্বেষ হয় এক ও অভিন্ন। এইব ধর্মীয় বিধিবিধান বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান এইগুলো সবই হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের হাতিয়ার- সব ধর্মই, কোনো ব্যতিক্রম নেই। কাদের সিদ্দিকী বা নাদের সিদ্দিকী যেই হন, তারা এই যে একেকটা বিজ্ঞের মতো ভাব ধরে এসব কথা বলেন, নারী এটা করতে পারবে না, ওটা করতে পারবে না, এখানে যেতে পারবে না, ওখানে প্রবেশ করতে পারবে নাÑ এগুলো সবই হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের ছোট ছোট প্রকাশ, সমাজের মজ্জাগত নারীবিদ্বেষের প্রকাশ মাত্র।
লেখক: আইনজীবী। ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
